পৃষ্ঠাসমূহ

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

সোমবার, ৫ নভেম্বর, ২০১২

আমার পোস্ট ঢাকা হচ্ছে কেন জানি না!!!


আমার পোস্ট ঢাকা হচ্ছে কেন জানি না!!!

আমার পোস্ট ঢাকা হচ্ছে কেন জানি না!!!

আমার পোস্ট ঢাকা হচ্ছে কেন জানি না!!!

আমার পোস্ট ঢাকা হচ্ছে কেন জানি না!!!
আমার পোস্ট ঢাকা হচ্ছে কেন জানি না!!!
আমার পোস্ট ঢাকা হচ্ছে কেন জানি না!!!

অপুর সংসার


অপু I.A. পাশ করেছে বটে, কিন্তু চাকরী এখনও জোটাতে পারেনি, চাকরীর সন্ধানে কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে থেকে টিউশন করে সে পেট চালায়অপুর সংসারের প্রথম দৃশ্যে অপু নিজের কলেজের এক শিক্ষকের কাছে character certificate নিতে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অপু এখন চাকরীর বাজারে এই এক টুকরো কাগজের মূল্য বোঝে – যা শহুরে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের নির্দেশক। বাড়ীওয়ালা বকেয়া ভাড়া চাইতে এলে তার সাথে পাক্কা শহুরে লোকের মত ঝগড়া করে অপু। নিশ্চিন্দিপুরের সেই সরল গ্রাম্য বালক এখন পুরোপুরি কলকাতার নাগরিক। বাড়ীওয়ালা ভাড়া না পেয়ে তাকে তুলে দেবার হুমকি দিয়ে চলে যাবার সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গেলে অপু সেটা এবং তার সঙ্গে বাইরের আলোটাও জ্বালিয়ে দেয় – তারপর আবার নির্বিকারে দারি কামানোয় মন দেয়। এই ধরনের consumer mentality আধুনিক শহুরে মধ্যবিত্তের বিশিষ্ট, যা অপু কলকাতায় থেকে শিখেছে, সর্বজয়াকে বকেয়া টাকার জন্য প্রতিবেশীরা চাপ দিলে তার বহিঃপ্রকাশ কিন্তু অন্যরকম ছিল!

বহু বছর বাদে কলেজের প্রাণের বন্ধু পুলুর সাথে দেখা হয় অপুর, ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে অপুকে খাওয়ায় পুলু, চাকরীর কথাও বলে। অপু বলে সে চাকরী করবে না, struggle করবে – এই যে অবস্থান সেটি শহুরে মধ্যবিত্ত রোম্যান্টিক মানসিকতার প্রকাশ, কারণ চাকরীর একটা খুবই দরকার অপুর। সেখানেও প্রধান বাধা মধ্যবিত্ততা; নইলে labeling এর কাজ করতে গিয়ে কেন অপুকে পালিয়ে আসতে হয়! অপু একটা উপন্যাস লিখছে, উপন্যাসটা আসলে আত্মজীবনী – পুলুর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে অপু, তার উপন্যাস কল্পনা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। এর সামান্য আগেই সধবার একাদশীর সংলাপ আওড়াচ্ছিল অপু, পুলু বলে প্রেম সম্বন্ধে তার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তাই প্রেমের কথা সে কল্পনা করেও লিখতে পারবে না। অপু পুলুর সাথে তর্ক করে চলে – যদিও তার যে প্রতিবেশিনী রোজ তার বাঁশি শোনার জন্য জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়, অপু তাকে দেখে লুকিয়ে পড়ে। নিজের মনের প্রকৃত ভাবকে গোপন করে কেবলমাত্র যুক্তির অবতারণা করে তর্ক করে যাওয়া, এটাও শহুরে মধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট্য।

পুলু অপুকে নিমন্ত্রণ কোরে তার মাসির মেয়ের বিয়েতে নিয়ে গেলে ঘটনাচক্রে অপর্ণাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় অপু, বিয়ের আগে পুলুকে যে চাকরীটা নেবে না বলেছিল সেটার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়, কারণ বিয়ে করতে কলকাতা শহরে সংসার পাততে গেলে আগে একটা চাকরী দরকার, সে অপর্ণা যতই বড়লোকের মেয়ে হোক না কেন! অপর্ণাও শহুরে দরিদ্র জীবনে দরিদ্র স্বামীর ভাড়াবাড়ির সংসারে মানিয়ে নেয়। স্বামী অফিস থেকে ফিরলে তার সঙ্গে মস্করা করে কাগজের ঠোঙা ফাটিয়ে, সিগারেটের প্যাকেটে অনুরধ লিখে রাখে সিগারেট না খাবার, বাড়িতে কাজের লোক না রাখতে চেয়ে অপুকে অনুরধ করে বাড়তি টিউশনগুলো ছেড়ে দেবার, আবার অপর্ণা খেতে বসলে অপু পাসে বসে তাকে বাতাস করে – এই সব কিছুর মধ্যে যে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শহুরে সংসারের ছাপ ফুটে ওঠে, সেটা নিশ্চিন্দিপুরে সর্বজয়ার সংসারে কখনই সম্ভব ছিলনা।

কাজলের জন্ম দিতে মৃত্যু হয় অপর্ণার। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত অপু আত্মহত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না – অপু আবার বোহেমিয়ান হয়ে পড়ে। এই যে escapism, এটাকেও আধুনিক মধ্যবিত্ত মুল্যবিধের প্রকাশ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আসলে অপু নিজের কাছ থেকে পালাচ্ছে। কোলিয়ারির চাকরীর আড়ালে দেখা যায় অপু নিজের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটিকে ছিঁড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। আধুনিক মধ্যবিত্ত পরিবারে পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা এতটাই বেশি যে অপুর পক্ষে তার উপন্যাসের মুখোমুখি দাঁড়ানটাও আর সম্ভব হচ্ছে না। কাজলকে অপু পছন্দ করে না, কারণ কাজল আছে বলেই অপর্ণা নেই। তবু পুলুর অনুরধে সে কাজলকে দেখতে যায়। কাজল আসলে অপুর শৈশবেরই এক দুরন্ত representation, চাকরদের কাছে মানুষ হবার ফলে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত ছেলেটা অত্যন্ত অবাধ্যতার কাছে কলকাতা এবং বাবা এই দুটো কথাই প্রায় সমার্থক, কারণ তাকে বলা হয়েছে তার বাবা কলকাতায় থাকে এবং দুটোই তার কাছে অদেখা। অপু বাবা হিসাবে কাজলকে ধরতে গেলে কাজল ঢিল ছুড়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়, কিন্তু সে যখন বলে সে কাজলের বন্ধু এবং তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চায়, তখন কাজল রাজি হয়। এইভাবে জৈবিক সম্পর্কের সীমানা ছাড়িয়ে মানবিক / সামাজিক সম্পর্ককে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা, এটাও আধুনিক শহুরে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের পরিচয়। অপুর সংসারের শেষ দৃশ্য – অপুর কাঁধে চেপে কাজল চলেছে কলকাতায়। অপুর আধুনিকতার যাত্রাপথ হয়ত এখন শেষের পথে, কিন্তু কাজলের যাত্রা এই শুরু হল। অধুনিকতা একটি চলমান প্রক্রিয়া, এবং এই আধুনিকতার সাথে সাথে মধ্যবিত্ত মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তনটাও অবশ্যম্ভাবী এবং সমভাবে গতিশীল।