পৃষ্ঠাসমূহ

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১২

পথের পাঁচালী - ২



পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে যে দুটি চরিত্রের মৃত্যু ঘটে, তারা হলেন ইন্দির ঠাকুরন আর দুর্গা। একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে অপু দুর্গা ইন্দিরের মৃতদেহ আবিষ্কার করে, সেটাই মৃত্যু সম্বন্ধে তাদের প্রথম অভিজ্ঞতা। এরপর দুর্গার মৃত্যু হয় বৃষ্টির জলে ভিজে, নিউমোনিয়ায়। দুর্গার মৃত্যুর সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে পরিচালক জানাচ্ছেন – অপুর পাঠশালায় যাবার দিন থেকে শুরু করে দুর্গার মৃত্যু পর্যন্ত এক বছর সময় কল্পনা করে চিত্রনাট্যের ঘটনাগুলিকে ঋতু অনুসারে ভাগ করে ফেলা হয়েছিল। চৈত্রের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গার অসুখ। সেই থেকে হরিহরের ফিরে আসার দিন, ঘটনাগুলো সবই মেঘলা দিনে তোলা হয়েছিল। উপন্যাসের এই অংশের যে নিরবচ্ছিন্ন ভারাক্রান্ত mood, ছবির আলোতে তার প্রতিফলন মেঘলা দিনে shooting ছাড়া সম্ভব নয়।


ইন্দির ঠাকুরন এবং দুর্গার মধ্যে বয়সের ব্যবধান অনেকটা হলেও এরা দুজনেই কিন্তু আসলে একই pre-modern feudal গ্রামীণ সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিনিধি, তাই আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে এদের থেমে যেতে হয়। পথের পাঁচালীতে কোথাও সরাসরি শহর বা আধুনিকতার reference নেই, কিন্তু অপুর রেলগাড়ি দেখবার ইচ্ছা, গভীর রাত্রে বহুদূর থেকে রেলগাড়ির আওয়াজ শোনা, এবং শেষ পর্যন্ত দুই ভাইবোনে কাশবনের মধ্যে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হটাৎ রেলগাড়ি দেখা – এ সমস্তই আসলে আধুনিকতার সন্ধানকেই সূচীত করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাসে অপু দুর্গার রেলগাড়ি দেখার ঘটনাটা অনুপস্থিত, এবং এটি সত্যজিতের তোলা পথের পাঁচালীর প্রথম দৃশ্য। ছবির গল্প অনুসারে রেলগাড়ি দেখতে গিয়েই বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গার অসুখ করে এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়। দুর্গার মৃত্যুর পরেই পথের পাঁচালীর কাহিনীর উপসংহার আসে এবং দেখা যায় হরিহরের অবশিষ্ট পরিবার গ্রাম ছেড়ে কাশি যাত্রার মনস্থ করেছে। এই পর্যায়ে হরিহরের অনুপস্থিতিতে দুর্গার মৃত্যুর পরে সর্বজয়ার জীবনসংগ্রাম আসলে সর্বজয়ার প্রাক আধুনিক গ্রামীণ অবস্থাকেই সূচিত করছে। Trilogy র পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যাবে, গ্রামীণ জীবনের সততার সংগ্রাম আধুনিক জীবনের যাত্রাপথে মূল্যহীন।


ছবির শেষ অংশে দেখা যায়, হরিহর ও সর্বজয়া অপুকে নিয়ে তাদের সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে নিজেদের বহুদিনের পরিচিত গ্রাম, গ্রাম্য জীবন ও মানুষজনকে ছেড়ে কাশি চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে পরিচিতকে ছেড়ে অজানা অপরিচিতের দিকে কর্ম, বাসস্থান ও ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি দেবার মধ্যে যে Rootlessness, তাও আসলে আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রাকে সূচিত করে, কারণ আধুনিক মানুষ শিকড়হীন, পিছুটান-হীন। যার সূত্র ধরে পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের Protagonist অপু সমস্তকিছু ছাড়িয়ে আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। পথের পাঁচালীর শেষ দৃশ্যে বাড়ির জিনিসপত্র গুছাতে গিয়ে অপু খুঁজে পায় দুর্গার চুরি করা একছড়া পুতির মালা। সবাইকে লুকিয়ে অপু মালাটাকে পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেয়, পুকুরের পানাগুলো বৃত্তাকারে মালাটিকে গ্রহণ করে, তারপর আস্তে আস্তে আবার ভরাট হয়ে যায়। পুতির মালা পুকুরে ডুবে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিন্দিপুরের ভিটের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হয় অপুদের। গরুর গাড়িতে করে তারা রওনা হয় অজানার উদ্দেশ্যে। অপুদের সঙ্গে তাদের মত গৃহহীন হয় তাদের বাড়ির বহু প্রাচীন বাস্তু-সাপ।      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন