এ ছবি শুরু হয় ১৩৩৭
সালে বারানসিতে। কাশিকে প্রথম দেখানো হয় গঙ্গার ওপর একটা রেল-ব্রিজে চলন্ত ট্রেন থেকে। এই রেলগাড়ি যেন
পথের পাঁচালীর সাথে অপরাজিতর মেলবন্ধন স্থাপন করল। কাশিকে Establish করা হয় গঙ্গা,
গঙ্গার ঘাট, ঘাটে স্নানার্থী, কথকতা, পুজো-আচ্চা, শরীরচর্চা, পায়রার দল, ইত্যাদি
নানা ঘটনা Deep focus এর মাধ্যমে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে। পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবন্ত শহর এই
বারানসিতেই আমাদের protagonist অপু প্রথম শহুরে মিশ্র সংস্কৃতির স্বাদ পায়। Deep focus এ দেখা যায় কাশির রাস্তায় দেওয়ালে আঁকা নানা
ধরনের ছবি, কাশির অলিতে গলিতে বন্ধুদের সাথে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় বালক অপুকে।
অপু হিন্দি বলছে, জলকে বলছে পানি, মা কি খেয়েছে জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিচ্ছে – ‘এক
লাড্ডু... অউর এক পেঁড়া’। বদলে গেছে মা সর্বজয়ার সংসারও। ঘিঞ্জি পরিবেশে বারো ঘর
এক উঠানের মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে আধুনিকতার প্রতীক হয়ে দাড়িয়ে থাকে জলের কল –
সেখানে বাঁদরের সাথে লড়াই করে সেই কল থেকে জল সংগ্রহ করতে হয় সর্বজয়াকে। পাঠশালা
যেতে না পারলেও শহরের আবহাওয়াতেই শিক্ষিত হয়ে উঠছে অপু, সে এখন জানে অপু ভালো ছেলে
ইংরাজি Apu is a good boy। তার অবাঙালী বন্ধু শম্ভু তাকে ইংরেজি শেখায়। নগরায়নের প্রভাবে
সর্বজয়ার রান্নাঘরেও এখন চা তৈরি হচ্ছে, অপু চা খাবে। এই সমস্ত
দৃশ্যায়ন থেকে একটি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে
রূপান্তরিত হওয়ার প্রথম ধাপটিকে নির্দেশ করছেন পরিচালক। শহরে রোজগার বেশি, খরচও
বেশি, সর্বজয়ার সখের ফরমায়েশ রাখতে হরিহর এখন কবিরাজি করছে, লোকের সঙ্গে হৃদ্যতা
বাড়ছে, ফলে ধারে জিনিস আনার সুযোগ বাড়ছে। সর্বজয়ার তাতে কোনও আপত্তি নেই! এই
সর্বজয়াই গ্রামে ছেলে নিয়ে না খেয়ে থাকার সময়েও মুখ ফুটে নিজের পড়শির কাছে টাকা
ধার চাইতে পারেনি! শহুরে পরিবেশে এসে অনেক পুরনো মূল্যবোধই এখন আর আঁকড়ে ধরে থাকা
যায় না।
দেওয়ালীর দিনে হরিহর
প্রথম অসুস্থ বোধ করতে থাকলেও দেওয়ালীর কাশি অপুর কাছে প্রথম বারের জন্য শহুরে উৎসবের আমেজ
তুলে ধরে। নাগরিকতায় নিজেকে দীক্ষিত করে তোলার পথে এই তার প্রথম
ধাপ। সর্বজয়া প্রদীপ দিয়ে ঘর সাজায়, বাজি পোড়াতে পোড়াতে অপু এখন ঠুমরীর সুর গুনগুন
করে। হরিহর অসুস্থ থাকাকালীন কামুক চরিত্রহীন প্রতিবেশীর নোংরামি থেকে নিজেকে কোনওরকমে
রক্ষা করে সর্বজয়া। শহরের এই নোংরামো
সর্বজয়ার কাছে অপরিচিত, কারণ সে এবং হরিহর এই দুজনেই
আসলে pry modern feudal গ্রামীণ সভ্যতার প্রতিভূ। এরা দুজনেই আধুনিকতার সামনে অপুর সবচেয়ে বড় পিছুটান
– আধুনিক মানুষ হয়ে উঠতে গেলে অপুকে এই পিছুটান-হীনতাকে গ্রহণ করতে হবে, কারণ আধুনিক মানুষ পিছুটান-হীন।
কাশিতে হরিহরের
মৃত্যুকে অত্যন্ত dramatic করে দেখিয়েছেন পরিচালক, কারণ এই মৃত্যুটাই অপুর
আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে সবথেকে বড় turning point। হরিহরের মৃত্যুর পরে সর্বজয়া একটি সম্পন্ন পরিবারে রাঁধুনির কাজ পায়। পরিবারের
সকলেই তার কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন বলে তাকে সেই পরিবারের সাথে তাদের বাড়িতে যেতে
অনুরোধ করেন পরিবারের গৃহিণী। অপুও বেশ মানিয়ে নিচ্ছিল
নতুন পরিবেশে, নিজের মত করে, বাড়ির কর্তা তাকে দিয়ে ফাই-ফরমাশ খাটান বটে, কিন্তু
বকশিশও করেন, অপুকে তিনি বিশ্বাস করেন, তার পয়সার বটুয়া কোথায় থাকে, অপু জানে,
নিজে হাতে তাকে সেটা এনে দেয়! বাড়ির কর্তা জানেন অপু ভদ্র ঘরের ব্রাহ্মণ-সন্তান,
অভাবের তাড়নায় তার ও তার মায়ের আজ এই অবস্থা, অপু চুরি করবে না। ইতিমধ্যে সর্বজয়ার মেশোমসাই ভবতারণ তাকে ও অপুকে নিজের গ্রামের
বাড়িতে নিয়ে রাখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই দোলাচলের মধ্যে বিভ্রান্ত
সর্বজয়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ দেখতে পায় অপু বাড়ির কর্তার হুঁকো নিয়ে
যাচ্ছে তামাক সাজতে। সর্বজয়া সিধান্ত নেয় সে ভবতারণের সাথে গ্রামে ফিরে যাবে। একটি Zip
Pan ব্যবহার করে পরিচালক আমাদের নিয়ে আসেন পরের দৃশ্যে, রেল
গাড়ি করে সর্বজয়া আর অপু চলে আসছে ভবতারণের গ্রামে।
এই দৃশ্যের
প্রসঙ্গক্রমে pry modern feudal গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মানসিকতা ও মূল্যবোধ বিষয়ে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া
যেতে পারে, যা থেকে বোঝা যায় ‘মধ্যবিত্ততা’ আপাতদৃষ্টিতে একটি আর্থ-সামাজিক অবস্থা বটে, কিন্তু তার থেকেও গভীর ভাবে দেখলে বিশেষ কিছু মূল্যবোধ
দ্বারা পরিচালিত একটি জীবন দর্শন। শহুরে জীবনে সর্বজয়ার
পরিবারে ক্ষণস্থায়ী স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল, শহরের সুখ সুবিধায় অভ্যস্ত হয়ে পরছিল
গ্রামীণ এই মধ্যবিত্ত পরিবারটি। নিশ্চিন্দিপুরে মিষ্টি কেনার জন্য অপু তার বাবার
কাছে পয়সা চাইলে সর্বজয়া বাধ্য হয়ে বারণ করত, কিন্তু এখানে বাড়ির কর্তার দেওয়া
পয়সা দিয়ে অপু বাঁদরদের জন্য খাবার কিনে তাদের খাওয়ায়, নিজের একাকীত্ব কাটায়। এই
আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করতে গিয়ে এই পরিবারটিকে যা বিসর্জন দিতে হচ্ছিল, তা হল
এই পরিবারের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের তকমা। নিরাপদ আশ্রয়, আর্থিক নিরাপত্তা, ভালো
মন্দ খাওয়াদাওয়া, এই সমস্তই অপু ও সর্বজয়ার হতে পারত, এই সম্পন্ন পরিবারটির আশ্রয়ে
থেকে, কিন্তু সর্বজয়ার কাছে দরিদ্র ব্রাহ্মণ পূজারী পরিবারের মূল্য বেশি বোধ হল,
তার কারণ তার pry modern feudal গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মানসিকতা ও মূল্যবোধ! সর্বজয়া গ্রামের শিক্ষিত পরিবারের বউ, অন্য পরিবারের
আশ্রয়ে থাকলে তার সন্তানকে ভবিষ্যতে বড় জোর ও বাড়ির বাজার সরকার রূপে দেখা যেতে
পারে, তার থেকে ভবতারণের গ্রামে গিয়ে অপুর পক্ষে পারিবারিক যজমান-বৃত্তিতে যোগ
দেওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক বলে মনে হয়েছে তার মায়ের কাছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,
বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাসে এই পর্বটির ব্যাপ্তি অনেকটাই বেশি, এই পর্বে লীলা নামে
অপুর একটি বান্ধবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সত্যজিৎ প্রথমে এই অংশটিকে চিত্রায়িত করার
পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, পরে লীলার চরিত্রে উপযুক্ত অভিনেত্রী না পাওয়ার কারণে সেই
পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।
শ্রী ঋত্বিক কুমার ঘটক এই ছবিটির এই পর্যায় সম্বন্ধে মত প্রকাশ করেছেন – অপরাজিততে
এই সুরটি (পথের পাঁচালীর theme) একবার মাত্র
ব্যবহার হয়েছে, যেখানে সর্বজয়া অপুকে নিয়ে ট্রেনে করে বেনারস থেকে বাংলাদেশে ফিরে
আসছেন। যেখানে জানলা দিয়ে যেই দেখা যায় ট্রেনটি বাংলাদেশে ঢুকছে – তখন মাত্র একবার
এটি বেজে ওঠে। ... এই সুরটি সঠিক জায়গায় ব্যবহৃত হয়ে নিজেকে নিশ্চিন্দিপুর আর
বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে নিয়েছে। অপরাজিত আমার মতে তার (সত্যজিৎ
রায়ের) সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন