পৃষ্ঠাসমূহ

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১২

অপরাজিত - ২


পথের পাঁচালীতে অপু রেলগাড়ির শব্দ শুনেছিল বাড়ি থেকে, নতুন গ্রামে বাড়ির কাছেই রেললাইন, অপুর তাই দিদির কথা মনে পরে যায়। এবারে সে এই বাড়ি থেকে রেলগাড়ি দেখতে পাবে। এ ছবিতে রেলগাড়ি ব্যবহৃত হবে একটা প্রতীক হিসাবে, গ্রাম ও শহরের সংযোগের প্রতীক। অপু শহরে যাবে, মা পরে থাকবেন গ্রামের বাড়িতে। পৈতৃক পেশা হিসাবে যজমানি শুরু করলেও অপু তাই মায়ের কাছে আবদার করে স্কুলে ভরতি হবার। স্কুলে  নিজগুণে শিক্ষকদের স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠার পরে শিক্ষকেরা তাকে পাঠ্যক্রমের বাইরে বই দেন, বলেন – বাংলাদেশের এক কোনে পড়ে থাকলেও মনটাকে বড় করে নেওয়া যায় বইয়ের মাধ্যমে। এই বইয়ের সূত্র ধরেই অপুর পৃথিবীটা বাংলাদেশের গ্রাম ছাড়িয়ে আরও বড় হয়ে উঠতে থাকে। পথের পাঁচালীর অপুর যাত্রার নায়ক সাজা আর অপরাজিততে আফ্রিকার আদিবাসী সাজার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এখানেই। অপু বিজ্ঞানের সহজ পরীক্ষা বাড়িতে হাতেকলমে করে দেখে, সূর্য ঘড়ি বানিয়ে তাতে সময় দেখে, মা কে গ্রহণের কারণ বোঝায়... শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হলেও এইভাবে আধুনিকতার লক্ষে নিজের অগ্রগতি অব্যাহত রাখে আমাদের protagonist।
অপু জেলার মধ্যে ম্যাট্রিকে দ্বিতীয় হয়েছে। ১০ টাকা মাসিক জলপানি আর পুরস্কার স্বরূপ একটা ছোটো গ্লোব হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরে অপু। গ্লোব হাতে নেবার মাধ্যমে সে যেন এক লহমায় বাংলার একটা ছোট্ট গ্রামের ছেলে থেকে বিশ্ব-নাগরিকে রূপান্তরিত হল। সর্বজয়ার সাথে প্রাথমিক দ্বন্দ্ব কাটিয়ে অবশেষে সে অনুমতি আদায় করে কলকাতা গিয়ে কলেজে পড়াশোনা করবার।
কলকাতা অপুর destination। এই গবেষণাপত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই কলকাতা শহর। এই ট্রিলজির এতদূর পর্যন্ত অংশে কলকাতা প্রত্যক্ষ ভাবে না থাকলেও এটাই আধুনিকতার উদ্দেশ্যে অপুর গন্তব্য – একথা অনস্বীকার্য। আধুনিক শহুরে মধ্যবিত্ততার অন্যতম বড় উপাদান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা সহজ ভাষায় Degree। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমেই এই গ্রামীণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের বালক একজন আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিকে রূপান্তরিত হবে।
অপুর প্রথমবার কলকাতায় আসা সম্বন্ধে পরিচালক লিখছেন – “ ভিড়ে ভরতি ইস্টিশানের প্লাটফর্মে সে ট্রেন থেকে নামল – এটা দেখিয়েই সরাসরি কাট করে দেখাব, সে একটা বড় রাস্তা পার হচ্ছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামছে বলে সে একটা গাড়ি বারান্দার তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টি যতক্ষণ না একটু ধরছে, ততক্ষণ সে এখানেই থাকবে। সেই সময় সে দেখতে পাবে হরেক জাতীর মানুষকে। পশতু ভাষায় কথা বলছে দুজন কাবুলিওয়ালা, জনাকয়েক চীনে, তাদের হাতে খাঁচা, খাঁচার মধ্যে পাখি – এরা পাখিওয়ালা। এরাও কথা বলছে নিজেদের ভাষায়। অন্য জনা কয়েক পথচারী হিন্দিতে। ... এই যে একটা মস্ত শহরে সে প্রথম পা রাখছে, সেই উত্তেজনাটাকে তো ছবিতে ধরতে হবে।”
কলকাতা শহর, ট্রামরাস্তা, মটরগাড়ি, নানা জাতের নানা ভাষাভাষী মানুষ, আধুনিক metropolis জীবনের প্রতীক হয়ে দেখা দেয় অপুর কাছে। অপু খুঁজছে হ্যারিসন রোডের কাছে ৫৪ নম্বর পটুয়াটোলা লেনের রয়্যাল প্রেস। এরকম রাস্তার নাম ও নম্বরযুক্ত ঠিকানা একটা শহুরে আধুনিকতার চিহ্ন অপুর কাছে। আসলে এই ঠিকানা খোঁজার মাধ্যমে অপু নিজের জীবনের metropolis আধুনিকতাকেই সন্ধান করে চলেছে। এই প্রথমবার জীবনে তাকে একাএকা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে কারণ কলকাতায় পয়সা খরচ করে থাকবার সামর্থ্য তার নেই। এইভাবে অপুর প্রেসে চাকরী নেওয়া, ছোট্ট ঘরে থাকা, বৈদ্যুতিক আলো, এ সবই আধুনিক metropolis জীবনের স্বাদ বয়ে নিয়ে আসে তার কাছে, যে জীবনের কথা সে এতদিন বইতে পড়েছে, আজ থেকে সে সেই জীবন যাপন করবে। মনের আনন্দে সে মা কে চিঠি লিখতে বসে।
কলকাতায় সিটি কলেজে সাইন্স নিয়ে I.A. তে ভরতি হয় অপু, রোল নম্বর ৪৬। একটি প্রতিষ্ঠান, একটি ক্লাস, একটি group of people, রোল নম্বরের মাধ্যমে কোনও মানুষের পরিচয় নির্দেশ করা, এ সমস্তই অপুর কাছে আধুনিক মেট্রোপলিস জীবনের উপাদান। কলেজ, ক্লাস, রোল, প্রক্সি – এ সমস্ত নতুন শব্দগুলো দ্রুত অপুকে আরও আধুনিক করে তোলে। ক্লাস পালিয়ে কলকাতার গঙ্গার ঘাটে আড্ডা মারে অপু, এ ছবিতে দেখানো ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন এবং নবীন দুটি শহরই গঙ্গার তিরে অবস্থিত, কিন্তু এদের চরিত্র আলাদা, কারণ কলকাতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় ক্রমে মেট্রোপলিসে রূপান্তরিত হয়েছে। পুলুর সাথে আড্ডা দেবার সময়েই বোঝা যায় এ সংসারে অপুর সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র পিছুটান তার মা সর্বজয়া। বন্ধুর ঘড়িতে সময় দেখে অপু, পরিচালক কাট করে দেখান, বাড়িতে অপুরই বানানো সূর্য ঘড়ির পাসে তার মা তারই অপেক্ষায় বসে আছেন।
অপু ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে ফেরে – কিন্তু মা ছেলের সম্পর্কের দূরত্ব আগের থেকে অনেক বেশি। তার কারণ, অপু সহজেই আধুনিকতাকে গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু সর্বজয়া প্রাচীন pry modern feudal গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। তাই মায়ের কলকাতা সম্বন্ধে জানাত আগ্রহ থাকলেও অপু কিছু বলার ইচ্ছে নেই। সর্বজয়া কলকাতায় গিয়ে থাকার কথা বলতে অপু ঘুমিয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত আর্থসামাজিক অবস্থাটা এক থাকলেও মা ও ছেলের মুল্যবোধে এখন অনেক তফাত, কারণ অপু এখন একজন শহুরে মধ্যবিত্ত। তাই গ্রামে মাদারির খেলা দেখে এখন অপু বিরক্ত হয়। গ্রামের জীবন সম্বন্ধে অপু এখন আগ্রহহীন; গ্রামের জীবনের আরাম, বিশ্রাম, সরলতা, ভালো খাবার, সহজ রোজগার, মাতৃস্নেহ... এ সব কিছু ছাড়িয়ে অপুর কাছে এখন অনেক বড় কলকাতার হাতছানি। Apu has gained the urge for Modernity. আমাদের protagonist নিশ্চিন্দিপুরের সেই ছোট্ট ছেলেটা এখন পুরোপুরি শহুরে মানুষ!
অপু পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবেনা – মানিঅর্ডারে দুটো টাকা পাঠাবার সাথে সে মাকে চিঠি লিখে এ খবর জানায়। আর সর্বজয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে হঠাৎ মনের ভুলে অপুর ডাক শুনে দরজা খুলে পুকুরপাড়ে জোনাকির ঝিকিমিকি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। মা অসুস্থ এই চিঠি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে অপু জানতে পারে সর্বজয়া মারা গেছেন। ভবতারণ তাকে গ্রামে থেকে যেতে বলেন। অপু জানায় তার পরীক্ষা আছে, কালীঘাটে সে তার মায়ের কাজ করবে। অপরাজিতের শেষ শট deep focus এ গ্রামের রাস্তা ধরে অপুর হেটে যাওয়া। জীবনে এই প্রথম বারের জন্য গ্রামের প্রতি তার আর কোনও পিছুটান রইল না, অপু এখন একজন সম্পূর্ণ শহুরে পিছুটান-মুক্ত আধুনিক মানুষ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন